নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশের যেকোনো শহরের সঙ্গে আশপাশের এলাকার পার্থক্যটি বোঝা যায় সড়ক দেখে। পৌর এলাকার বাইরের সড়ক যতই খারাপ থাকুক, শহরের ভেতরের সড়কগুলো থাকে ঝকঝকে। কিন্তু উত্তরের অন্যতম প্রধান শহর দিনাজপুরের চিত্র এর বিপরীত। সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুর শহর অবধি সড়কটি বেশ ভালো। শহরের ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় বেশির ভাগ সড়ক খানাখন্দে ভরা। দুই পাশে ময়লা-আবর্জনা। ব্রিটিশ আমলে তৈরি গোর-এ-শহীদ ময়দান। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতে ময়দানের দেয়ালজুড়ে চলছে আলোকসজ্জা। একদিকে লোডশেডিং, অন্যদিকে আলোকসজ্জা। মনে হলো দেখার কেউ নেই। জানতে চাইলাম, দিনাজপুরের সমস্যা কী? উপস্থিত জনতা জানান, প্রথম সমস্যা ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। দ্বিতীয় সমস্যা অনিয়ন্ত্রিত ইজিবাইক। বাস টার্মিনালগুলো অপরিচ্ছন্ন। কয়েক কিলোমিটার দূরে হিলি সীমান্ত। সেখান থেকে মাদক আসে। তরুণদের একাংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নিষ্ক্রিয়। শিশু–কিশোর সংগঠনেরও কোনো তৎপরতা নেই। দিনাজপুরে প্রচুর শস্য, ফল ও সবজি চাষ হয়। কিন্তু কোনো কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠেনি। সেতাবগঞ্জ চিনিকল ও দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলও বন্ধ হয়ে গেছে। কারখানা বন্ধের মধ্যেই সরকার সমাধান খুঁজছে। লাভজনক করে চালানোর চেষ্টা করছে না। ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুর পৌরসভার রাস্তাঘাটের এই দুরবস্থা কেন?? উত্তরে তাঁরা যা বললেন, তার সারকথা হলো, সদরের এমপি ও হুইপ ইকবালুর রহিম ও পৌরসভার মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলমের দ্বন্দ্বের কারণে দিনাজপুরের সবকিছু থমকে আছে। কোনো উন্নয়নকাজ হচ্ছে না। নাগরিকদের কল্যাণে নতুন প্রকল্প দূরে থাক, রুটিন কাজগুলোও করা যাচ্ছে না অর্থের অভাবে। দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র বিএনপির। সরকার আওয়ামী লীগের। কাউন্সিলরদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের। এ কারণে মাঝেমধ্যে পৌরসভার কাজকর্মে অচলাবস্থা দেখা দেয়। রাস্তাঘাটে খানাখন্দ থাকলেও মোড়ে মোড়ে সরকার দলীয় নেতৃবৃন্দের ছবি–সংবলিত পোস্টার ও ফলক ঠিকি শোভা পাচ্ছে। অনেকের কাছ থেকেই জানতে পারলাম, গত ১৫ জুন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কাজে অদক্ষতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মসহ ৯টি অভিযোগ আনা হয়। এসব অভিযোগ সব মেয়রের বিরুদ্ধেই কমবেশি আছে। তাই বলে তাঁরা বরখাস্ত হন না। বরখাস্ত হন বিরোধী দলের মেয়ররা। উচ্চ আদালতে রিট করে সৈয়দ জাহাঙ্গীর এ যাত্রা রক্ষা পেয়েছেন। এর আগেও দুবার তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। সরকার অযোগ্যতার অভিযোগ এনে সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে বরখাস্ত করে আর জনগণ তাঁকে তিন–তিনবার বিপুল ভোটে মেয়র করেছেন। রহস্যটা কী? সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি পৌরসভা নির্বাচনেও সৈয়দ জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে প্রায় ২১ হাজার ভোটে হারিয়ে দেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ অভ্যন্তরীণ কোন্দল। স্থানীয় এমপির সমর্থক প্রার্থী নৌকা প্রতীক পেলেও যুবলীগের এক নেতাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পৌরসভার গত ১১ নির্বাচনের একটিতেও আওয়ামী লীগ–সমর্থিত বা মনোনীত প্রার্থী জিততে পারেননি। পাঁচবার জিতেছেন বিএনপি-সমর্থিত বা মনোনীত প্রার্থী। পাঁচবার স্বতন্ত্র প্রার্থী। একবার ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী। দিনাজপুর আওয়ামী লীগ নানা উপদলে বিভক্ত। এক উপদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হুইপ ইকবালুর রহিম। আরেক উপদলে প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্‌মুদ চৌধুরী। আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সঙ্গে সদরের বাইরের পাঁচ আসনের এমপির দ্বন্দ্ব এখন আর লুকোছাপার বিষয় নয়। একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন, তিনি জেলা কমিটি মানেন না। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে একাধিকবার তারিখ ঘোষণা করেও জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। দিনাজপুর পৌরসভা ভবনটি মাথার ওপর পড়ো পড়ো অবস্থা। অনেক স্থানে পলেস্তারা খসে পড়েছে। তারপরও নতুন ভবন নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেই। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাই প্রশ্ন করলেন, নিজেদের কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিততে পারেন না। আর সে জন্য সরকার দিনাজপুরবাসীকে শাস্তি দিচ্ছে। বিএনপি আমলে তো ইয়াসমিন হত্যার প্রতিবাদে এখানে বিশাল আন্দোলন হয়েছিল। উন্নয়নের দাবিতে কেন আন্দোলন করছেন না আপনারা? তাঁরা বলেন, কীভাবে আন্দোলন হবে। রাস্তায় নামলেই পুলিশের মার খেতে হয়। সাংবাদিকদের ওপরও প্রচণ্ড চাপ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, আওয়ামী লীগ ১৩ বছর ক্ষমতায়। শিল্পকারখানা দূরে থাক, এখানে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান তারা করেনি। অথচ বিএনপি আমলে এখানে শিক্ষা বোর্ড হয়েছে। জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের হৃদ্‌রোগীদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান এটি। ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত এ হাসপাতাল বিএনপি আমলে প্রচুর সরকারি সহযোগিতা পেত। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তা বন্ধ আছে। সাধারণ জনগণের প্রশ্ন তা কি শুধু নামের কারণেই? তাহলে কি এমপি-মেয়র দ্বন্দ্বে অবহেলায় এভাবেই দিনের পর দিন অতিবাহিত করতে হবে দিনাজপুরবাসীকে??